মহাকাব্যের গল্পে কিছু ইতিহাস থাকে কিছু কল্পনা থাকে.......কিছু সত্য, কিছু কবি বা লেখকের স্বাধীনতা....এবং এই সব মিলিয়েই সাহিত্য ইতিহাস হয়, ইতিহাস মহাকাব্য হয় | কিন্তু অনেক সময় কাব্যের গল্পের প্রাধ্যানে মূল ইতিহাস আড়ালে চলে যায়, বা হয়তো ইচ্ছে করেই নীতি, ন্যায় নিষ্ঠা, ইত্যাদি মানব চরিত্রের মৌলিক গুণ গুলোর তাৎপর্য্য বোঝাতে ইতিহাসকে ফ্রেম এর পেছনে পাঠিয়ে দেয়া হয়, backdrop বলে যাকে | সেই গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র অনেক থাকতো কিন্তু গল্পের গতি ও লক্ষ্য ঠিক রাখতে এক নারী চরিত্রের প্রাধান্য অপরিহার্য্য....সেই নারীর জীবন জন্ত্রণা, তার প্রতি সামাজিক অন্যায়, নর-নারীর প্রাকৃতিক আকর্ষণ, প্রেম ভালোবাসা, লোভ, ঈর্ষা, বিদ্বেষ, জিঘাংসা সব মিলিয়ে গল্প অনবদ্য রূপ নিত, লোকের কাছে গ্রহণ যোগ্য হয়ে উঠতো | হারিয়ে যেত ইতিহাসের শিক্ষা বা গতিপথ....বোরো হয়ে উঠতো গল্প......Larger than Life | Women Empowerment Flagship এর ধারক বাহকদের আপত্তি থাকতে পারে এই মতামতে......কিন্তু এটা একান্তই ব্যাক্তিগত এবং আমার চোখে বা মানসে এটা সত্য | সত্য পছন্দ নাহলেও তা সত্য, আর পছন্দসই সত্য উপহার দিলে সেটা গল্প | Women are part of the Story...not the Story......Truth is stranger than Fiction!
Troy এর ভৌগোলিক অবস্থানের সুবাধে যেকোনো দেশ বা রাজ্যকে বাণিজ্য করতে গেলে বাণিজ্যিক শুল্ক/কর দিতে হতো ট্রয়কে, সেটাই ছিল ট্রয় সাম্রাজ্যের সব চেয়ে বড় রাজকোষের উৎস | সেই কর দেয়াতে আপত্তি থাকলে ট্রয়কে জয় করা অপরিহার্য্য......এবং তাই হয়তো কোনো সময় কোনো যুদ্ধে ট্রয় রাজ্যের পতন হয় | তৎকালীন সমাজে পাশ্চাত্য সভ্যতাতে দাসত্ব, হারেম, পলিগ্যামি ইত্যাদি পাওয়া যায়, কিন্তু রাজ্ ঘরানার মহিলাকে ছল পূর্বক নিয়ে আসার গল্প হয়তো শোনা যেত না | হেলেন তাই অমর হলেন....এরকম কোনো ঘটনা ঘটেছে কি ঘটেনি সেটার চেয়েও বড়......গল্পের নায়ক নায়িকা হলেন রাজা আর রানী.....হারেম বা দাসত্ব প্রথার কোনো সাধারণ লোক নয় | ম্যাগনাম অপেরা তৈরী করা যায় না রাজা রানী ছাড়া........রাজকাহিনী সামনে রেখে সাম্রাজ্যবাদের ইতিহাসের মূল কারণকে আড়াল করে রাখা যায় | ম্যাজিক !!!
রামায়ণ অনেকে বলেন রামের জন্মের আগে রচনা, সেটা যদি আলংকারিক মতামত হয়, বিধাতার রচনা হিসেবে, তাহলে আলাদা কথা, কিন্তু যদি আক্ষরিক অর্থে সেটা নেয়া হয়, গোটা রামায়নটাই গল্প | আমার মনে হয় ওটা তৎকালীন ইতিহাসের প্রতীক | হয়তো আর্য অনার্য্যের সাম্রাজ্যবাদের ইতিহাস, যদিও সাম্প্রতিক কালে এই নিয়ে অনেক মতো বিরোধ আছে | উত্তর এর দক্ষিণ জয়ের নীতি বা গল্পই রামায়ণ, উত্তর দক্ষিণের লড়াইয়ের ইতিহাস ..... যেখানে রূপে রঙে উন্নত উত্তরের কাছে দক্ষিণের মানুষ বানর বা রাক্ষস.....আর উত্তরের সমস্ত রকম superiority complex কে জয়ী করতে একটি শক্তিশালী দক্ষ শত্রুর দরকার....তাই রাবণের আবির্ভাব | কিন্তু গল্পের গরিমা তখন বাড়বে যখন সর্ব শক্তিমান রাবণ কোনো "ভিখারী রাঘব" এর হাতে পরাজিত হবে, যে দক্ষিণের গৌরবকে স্বীকৃতি দেবে কিন্তু আলাদা হিসেবে নয়, উত্তরের annexure হিসেবে | কিন্তু রাম রাবণের যুদ্ধের কারণ কি হবে.....ন্যায় নীতির বিচারে ? তাই সীতাকে লাগবে, রাবণ অপহরণ করবে সীতাকে ... যুদ্ধ হবে....সাম্রাজ্যবাদের প্রতিপত্তি বাড়বে, দক্ষিণের স্বীকৃতি আসবে ন্যায় নীতির আড়ালে |
সামাজিক প্রেক্ষাপটে কিছু অবদান আছে সাহিত্যের....তাই মহাকাব্যের মধ্যে দিয়ে এক অনাথ গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র হলেন, রাজা জনক যাঁকে কন্যা হিসেবে স্বীকার করলেন, দশরথ যাঁকে তার পুত্রবধূ হিসেবে গ্রহণ করলেন | সেই সীতা যে দ্বিতীয়বার অগ্নিপরীক্ষা দিতে রাজি হননি, এবং রাজা হিসেবে রামের সেই ব্যর্থতার শাস্তি হিসেবে poetic justice করা হলো পুত্রদ্বয় লব-কুশ এর হাতে রামের পরাজয় | যারা এখনো অনাথ বা single parent child দের অন্য চোখে দেখেন....বা রাগের মাথায় কেউ যখন কাউকে 'bastard' বলে থাকেন....একটু ভাবনা চিন্তা করে নেবেন |
লঙ্কা
জয়ের পর রাম কিন্তু
বনবাস বা ত্যাগ বেছে
নিলেন না, অযোধ্যা অধিপতি
হলেন.....ইতিহাসের চোখে একেই তো
সাম্রাজ্যবাদ বলে ! গল্পের আবেগের
মধ্যে সুন্দর ভাবে ঢাকা
পরে যায় সাম্রাজ্যবাদের ইচ্ছে
আর কারণ...the Real Story behind the
story | Ironically/Coincidentally লক্ষ্য
করেছেন কিনা জানিনা, ব্রিটিশ আসার আগে অব্দি উত্তরের কোনো রাজা বা বহিরাগত কোনো শক্তি
কেউই দক্ষিণ জয় করতে পারেনি.....রামায়ণ তাই খুব গুরুত্বপূর্ণ গল্প হয়ে থাকলো উত্তরের
কাছে |
মহাভারত, মহাকাব্যের মধ্যে আজ ও যার স্থান আলাদা, তার কারণ তার প্রাসঙ্গিকতা আজকের যুগেও অনস্বীকার্য্য | মহাভারতের বহু চরিত্র আছে যাদের নিয়ে বহু উপন্যাস রচনা হয়েছে, বা পরেও হয়তো হবে.....তার কারণ তাদের জীবনের প্রতিচ্ছবি আজকের সমাজেও খুঁজে পাওয়া যায় |
ঐতিহাসিকের
চোখে মহাভারত ভূমি দখলের লড়াই......শুধু সাম্রাজ্যবাদ নয়, ভূমি অধিগ্রহনের গুরুত্ব,
ইন্দ্রপ্রস্থর মতন অনুর্বরজমিকে শক্তিশালী করে নেওয়ার ক্ষমতা আর দূরদর্শিতার ইতিহাস....দ্যুতক্রীড়া
বা Betting , Fixing এর মধ্যে দিয়ে অর্থ উপার্জন, জমি অধিগ্রহনের, সেই প্রচেষ্টাতে
মহিলাদের ভূমিকা....এই সবের ইতিহাস মহাভারত....এবং তাই আজ তার কেন এতো প্রাসংগিকতা
সেটা বোঝা যায় | এরকম একটা গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাসের, মহাকাব্যের চরিত্র আর গল্প নির্মাণ
করা সামাজিক প্রয়োজনীয়তাগুলো মাথায় রেখে...বিরাট দায়িত্ব এবং তাই সেই নির্মাণ এর পেছনে
আড়ালে চলে যায় আসল ইতিহাস....সময় আর মানুষের ইতিহাস |
মহাভারত
নিয়ে কথা বলতে গেলে কিছু চরিত্রের কথা বলতে হয়..কারণ তবেই বোঝা যায় সময়ের সঙ্গে সঙ্গে,
সাম্রাজ্যবাদের কারণে কিছু নিয়ম নীতি কেমন পাল্টে যায়...বা চিন্তাধারার পরিবর্তন হয়
|
কৃষ্ণ
: মহাভারতের নায়ক, Foster Parenting এর এক উদাহরণ | Womanizer হিসেবে যাকে উদাহরণ
দেখানো হয় .... স্টেটসম্যান হিসেবে তার অসামান্য অবদান | অর্থাৎ একই মানুষ যাকে হয়তো
দুশ্চরিত্র হিসেবে অনেকে দেখতো বা বাতিল করত, তার রাজনৈতিক চিন্তাধারাকে দেখে তাকে
নায়ক বানালো...multi-faced talent | সীতার অপহরণে রাবণ খলনায়ক, কিন্তু সুভদ্রার অপহরণে
বা রুক্কিনির অপরহরনে অর্জুন বা কৃষ্ণ কিন্তু নায়ক......অর্থাৎ সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে
চরিত্র অঙ্কনের পরিবর্তন | গীতাতে অর্জুনের উদেশ্যে কৃষ্ণের যা বক্তব্য তাকে Motivational
Speech for political necessity by an intellect of highest order বলতে কোনো দ্বিধা
নেই....কিন্তু সেই একই ব্যাক্তি যখন কর্ণকে যুধ্যের আগে প্রকৃত পরিচয় জানিয়ে দেন সেটা
অনৈতিক যুদ্ধ নীতির পরিচয়......কিন্তু সাম্রাজ্যবাদের চোখে সেটা ঠিক |
দ্রৌপদী : পলিগ্যামি প্রথা পুরুষ সমাজে স্বীকৃত ছিল, স্বয়ং কৃষ্ণ সেই প্রথার বাইরে ছিলেন না.....কিন্তু মহিলা মহলে এ প্রথা চালু ছিল না.....তাই গল্পের নায়িকাকে সেই অ্যাসিড টেস্ট এ নামতে হতো...তাই তিনি অগ্নিকন্যা....এই ঘটনার মধ্যে দিয়ে এবং কৃষ্ণের certification এর মাধ্যমে মহিলাদের সমান অধিকারে বসানো গেলো |
সমাজের
কিছু চলে আসা প্রথার গুলোর পরিবর্তনের গল্প মহাভারত.........দ্যূতক্রীড়াতে মহিলাদের
ব্যবহারের কুরুচিপূর্ণ প্রথা পরিবর্তনের, সমাজে মহিলাদের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠার গল্প
|
পাণ্ডবরা
ছিলেন কুরুবংশের দত্তক পুত্র, কিন্তু তারা সিংহাসনের যোগ্য উত্তরসূরি.....তাই বংশপরম্পরায়
সিংহাসন অধিগ্রহনের পরিবর্তনের গল্প মহাভারত | কুরুক্ষেত্রের যুধ্যের শেষে দুপক্ষের
কুরুবংশের কোনো উত্তরসূরি বেঁচে থাকে না.....পরীক্ষিতের পুনর্জন্ম করানো হয়.....বংশপরম্পরার
অবসান ঘটাতে | একদিকে যেখানে পাণ্ডবদের জন্য কৃষ্ণ লড়ছেন, সেখানে তিনি নিজে বা বলরাম
দ্বারকানাথ হতে পারেন না......দ্বারোকার সিংহাসনে বলরাম বা কৃষ্ণ বসেননি....তৎকালীন
প্রজাতন্ত্র বসিয়েছিলেন যা অনেকটা পঞ্চায়েত বা রোমান সেনেট্ এর মতন....তাই প্রজাতন্ত্রের
গল্প মহাভারত |
পাণ্ডব,
কর্ণের মতন অনাথদের সামাজিক স্বীকৃতির গল্প....একলব্যের মধ্যে দিয়ে সমাজের নিচু শ্রেণীর
ওপর অত্যাচারের গল্প.....শিখন্ডি, বৃহন্নলার মধ্যে দিয়ে সমাজের মূল ধারাতে
transgender দের অন্তর্ভুক্তির গল্প...রাধা কৃষ্ণের প্রেমের মধ্যে রীতিবিরুদ্ধ কিন্তু
নির্ভেজাল প্রেমের গল্প......এ সবই সামাজিক পরিবর্তনের প্রতিচ্ছবি |
ভীষ্ম
: মহাভারতের একমাত্র চরিত্র...১৮ দিনের যুদ্ধে যিনি একা ১০ দিন নিশ্চিত করেছেন যাতে
দুপক্ষের কোনো রথী মহারথীর প্রানঘাট না হয়.....সেই অপ্রতিরোধ্য যোদ্ধা যার কাছে সময়
হার স্বীকার করেছিল, যাকে বধ করতে কৃষ্ণ উদ্বত হয়েছিলেন....যাকে অস্ত্র ত্যাগ করাতে,
ভূমিষ্ঠ করতে তারই পরামর্শে শিখন্ডিকে সামনে আন্তে হয়েছিল.....সেই ভীষ্ম যিনি চাইলে
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ হয়না....অথচ তিনি প্রতিজ্ঞা আর ধর্মের ভ্রান্তিতে ঠিক পথ হারিয়ে
ফেললেন....হস্তিনাপুরের বিভাজন করালেন কিন্তু যুদ্ধ আটকাতে পারলেন না | অথচ কৃষ্ণ তাঁকে
সেই সময় পরামর্শ দিলেন না...কেন.....সাম্রাজ্যবাদের নিয়মে কি হস্তিনাপুরের প্রতিপত্তির
শেষ দরকার ছিল ? History repeats itself.... ১৯৪৭ এর দেশভাগের সময় কি আমরা এরকম কিছু confused minds &
reluctance দেখি না ?
মহাকাব্যের এতো গল্পের আড়ালে তাই গোপন থাকে আসল উদ্দেশ্য, সাম্রাজ্যবাদ স্থাপনের ইতিহাস.... সামনে থাকে কিছু অতিনাটকীয় মুহূর্ত আর চরিত্র...হারিয়ে যায় আসল মানুষের ইতিহাস !
যারা
পুরানপন্থি এবং দেশের কৃষ্টি আর সভ্যতাকে পুরোনো গ্রন্থে, সংস্কৃত মন্ত্রে আটকে রেখেছেন
তারা নতুন কোনো জিনিস সমাজে দেখলে অপভ্রংশের দোহাই দেবেন না....অনেক কিছুই আপনাদের
ওই গ্রন্থের স্বীকৃতিতে আছে, আপনাদের স্মৃতি আর জ্ঞানের বাইরে |
Disclaimer
: The above ideas are solely based on personal interpretations of events,
history, stories against the political, social & cultural aspect of the
society in a particular time frame. This
does not intend to teach, hurt or question anyone's feeling, belief &
sentiment.
No comments:
Post a Comment