Sunday, September 06, 2020

একটি কাল্পনিক কথোপকথন

স্বর্গের নন্দন কাননে প্রাতঃভ্রমনে বেরিয়েছেন কবিগুরু। আজকে প্রকৃতি যেন আনন্দরূপ। মর্ত্যলোকের মত এখানেও দিনে দিনে ভিড় বেড়ে চলেছে। কবি একটা নিভৃত কোনের দিকে এগিয়ে চলেন, ওদিকটাতে লোকের সমাগম কম। ওদিকে যেতে যেতে প্রাকৃতিক শোভা অনুভব করছেন কবি, একটি কণ্ঠ শুনতে পেলেন, ভোরের রেওয়াজে বসেছে কেউ, খালি গলাতে, আহা কি অদ্ভুত কণ্ঠস্বর। কিছু দূর এগোতেই দেখতে পেলেন, এ যে মহম্মদ রফি। কবিগুরু কিছু বললেন না গায়কের পেছনে গিয়ে দাঁড়িয়ে গান শুনতে লাগলেন, ভৈরব রাগ, একটু দূরে দাঁড়ালেন। রফি একমনে গেয়ে চলেছেন, হঠাৎ কবির কাশির দমকে থেমে গেলেন। চেয়ে দেখলেন রবীন্দ্রনাথ দাঁড়িয়ে আছেন।

লজ্জিত হয়ে উঠে দাঁড়ান গায়ক, হাত জোড় করে বলেন "ক্ষমা করবেন গুরুদেব, "আপনি  এসেছেন টের পাইনি, এ তো সাক্ষাৎ ভগবান ভক্তের কাছে, আপনি বসুন।"

"আরে করো কি রফি সাহেব, আমি তো তোমার সাধনায় বাধ সাধলাম, কি অপূর্ব গাইছিলে, আমি তোমাকে তুমি বলেই বলছি, আপনি বললে তোমাকে পর করে দেয়া হয়, তোমার সঙ্গে আলাপ যখন হয়েছে, আর মুক্তি নেই তোমার। "

খিলখিলিয়ে হেসে ওঠেন রফি, বিশ্বকবিকে প্রণাম করেন, "কতদিনের ইচ্ছে আপনার সঙ্গে দেখা করব কিন্তু সুযোগ হচ্ছিলো না। আপনার কাশি হয়েছে দেখছি, তাবিয়াত ঠিক আছে তো ?"

"সাহেব,শরীর ঠিক আছে, বৃদ্ধবয়েসে এসেছি, তাই এগুলো একটু আধটু লেগে থাকে, তবে ভালো কি জানতো বিনা ওষুধে সেরে যায়, ডাক্তার বদ্যিতে আমার বড় allergy।"

এ কথা সে কথা চলতে থাকে দুজনের, গায়কের কাছে এ যেন এক মহামিলন, কবির কাছে এক অবিস্মরণীয় মুহূর্ত। 

সহসা কবি বলে ওঠেন "তোমাকে গান গাইতে দেখে ভালো লাগলো, আমার তো আজকাল লেখা হয়না। বয়েসও হয়েছে, সময়ও অনেক পাল্টে গেছে, চতুর্দিকে এতো গতি হয়ে গেছে, লোকের জীবনে এতো অনিশ্চয়তা এসেছে কারুর আর ধৈর্য্য ধরে কিছু পড়ার মন নেই, কি করবে বাঁচবে, না সাহিত্য চর্চা করবে।" 

"ঠিকই বলেছেন গুরুদেব, লোকের  জীবন থেকে স্বস্তি চলে গেছে, গানের কথা-সুর সব তাই পাল্টে গেছে। গান বাজনা সাহিত্য সবই তো সময় এর প্রতিবিম্ব।"  

"খাসা বললে রফি সাহেব।" 

কিছুক্ষণের  নীরবতা......রফি বললেন "গুরুদেব আমার জীবনের একটা  দুঃখ আছে, এতো গান গেয়েছি, বাংলাতেও  গেয়েছি, নজরুলগীতি ও গেয়েছি, কিন্তু কেউ কখনো আপনার গান গাইতেই বলেনি আর আমিও সাহস করে কাউকে মনে ইচ্ছের কথা বলতে পারিনি।"

অট্টহাস্যে ভেঙে পড়েন কবি, "ভালো করেছো যে বলোনি কাউকে, তোমাকে ওরা গাইতে দিত না ঠিক করে, নিয়ম দেখিয়ে তোমার দম আটকে দিতো, হাঁস ফাসঁ করে পালিয়ে  বাঁচতে। স্কুল খুলেছিলাম খোলা মনে গড়ে ওঠার জন্য, উল্টে ওরা আমাকে নিয়মে বেঁধে ফেললো। তোমাকে বোঝে ওদের কি সাধ্যি। তুমি ভেবোনাহে এখন থেকে তোমার মুক্তি নেই, আমার গান আমি তোমার গলাতেই শুনবো। লোকে ঈশ্বর এর খোঁজে বেরোয় তুমি তো গলাতে ঈশ্বরকে বসিয়ে রেখেছো, তুমি তো Sufism এর প্রতীক।"

"তওবা তওবা, আপনি আমায় লজ্জা দেবেন না। আপনার লেখাতে তো সর্বত্র তাঁর অস্তিত্ব। "

কবি এবার লজ্জিত হন....আবার কিছুক্ষনের নীরবতা....রবীন্দ্রনাথ বলে ওঠেন, "বেলা বাড়ছে এবার যাবো, যাওয়ার আগে আমাকে একটা গান শোনাও" 

চমকে ওঠেন রফি, এ আবদার যেন তার জীবন ধন্য করে দিল কিন্তু কি গাইবেন বুঝে উঠে পারছেন না।

"অতো চিন্তা করোনা, তোমার গান গাও, সেই গান... ও দুনিয়া কে রাখবালে....আহা কি সুন্দর গেয়েছো ...কিংবা আমার ওরকম কোনো একটা ..." গায়কের বিহ্বলতা দেখে একটু কৌতুক করে কবি বলেন "এখন থেকে তো আমার গানে তোমার দিন কাটবে..মুক্তি নেই।"

স্থির হয়ে চোখ বুজে কিছুক্ষন ভাবেন রফি ... শুরু করেন ... "মহারাজ এ কি সাজে  ......"

গান শুনতে শুনতে আবেগে আপ্লুত হয়ে রুদ্ধ হয়ে যাই কবির কণ্ঠস্বর, অবিরত অশ্রু ধারায় ভিজে গেলো তার পোশাক....স্রষ্টা আর গায়ক দুজনের চোখ বন্ধ....জাগতিক দিকে আর মন নেই।

গান শেষ..আবার নীরবতা, গায়ক ভাবছেন তার জীবনের যেন ষোলকলা আজ পূর্ণ হলো। কবি ভাবছেন এ কি শুনলেন....এতো লোকের এতো রকম গায়কীতে শুনেছেন এই গান....কিন্তু এ তো সবার উর্দ্ধে, সাক্ষাত লালন এর গান....এই গানের অন্য মানে করে দিলেন গায়ক....ফকির এর প্রত্যাশা বিহীন ভালোবাসার কাছে ঈশ্বর ছোট হয়ে গেলো....সৃষ্টির কাছে স্রষ্টা আজ সত্যি ছোটো....এই যেন চেয়েছিলেন তিনি গানে বলতে....আপ্লুত হয়ে আর কিছু বললেন না রবীন্দ্রনাথ...জড়িয়ে ধরলেন রফিকে ....বললেন "অসংখ্য ধন্যবাদ....আজ চলি আবার আপনার সঙ্গে দেখা করবো..আজ কিছু লিখবো....চলি।"

রফি বুঝলেননা কি বলতে চাইছিলেন গুরুদেব....কিছুক্ষণ বসে থাকলেন....তরপর গান গাইতে গাইতে নিজের গন্তব্যের দিকে এগোলেন।


Disclaimer : The writing is a product of imagination of the author & intent is purely literary. Neither there is an attempt to establish any idea nor criticise any section or community of the society


No comments:

Post a Comment

Dangal

There are not many days when deep into the night the Country kept staring at the TV set or the Mobile Screen without the prospec...